Menu

আলোর প্রদীপ সংগঠনের শুরু যেভাবে

“ উদয়ের পথে শুনি কার বাণী

ভয় নাই ওরে ভয় নাই,

নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান

ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।“

কবি গুরু রবিঠাকুরের কথার সূত্র ধরে শুধু বলতে চাই যে প্রাণ অন্যর জন্য ব্যয়িত, সে প্রাণের স্থায়ীত্ব চিরসমুজ্জ্বল, চিরভাস্বর। লেখার শুরুতেই পরম শ্রদ্ধার সহিত স্বরণ করছি আমার প্রিয় শিক্ষক ও “আলোর প্রদীপ” সংগঠনের সম্মানিত উপদেষ্টা শ্রদ্ধেয় মরহুম বাহার উদ্দিন ও একরামুল হক সাজু কে। আরো স্বরণ করি সংগঠনের অন্যতম সদস্য কৃতি ফুটবল খেলোয়ার সোহেল আহম্মেদ কে। তারা আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাদের নীতি,আদর্শ রেখে গেছেন আমাদের মাঝে। যা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালনের আ-প্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

সংগঠনের শুরু থেকেই যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে আমার অবিচ্ছেদ্য একটি আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সেহেতু নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই এই সংগঠনের সূচনা লগ্নের কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যেভাবে মাথায় চিন্তাটি আসলো । তখনো সংগঠন কিভাবে করতে হয় বা কিভাবে চালাতে হয় সে সম্পর্কে কোন ধারনাই আমার ছিলো না।কারন তখন সবে দ্বাদশ শ্রেণিতে অবস্থান আমার। একদিন বৃষ্টি দিনে বারান্দায় বসে দাদা আমি আর দাদি ও পাশের বাড়ির সম্পর্কে ভাবী বসে গল্প করছি।গল্পের এক পর্যায়ে ভাবীর ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার আলাপ তুললেন দাদা। তখন ভাবী বেশ আক্ষেপ নিয়েই বলছে যে, “কেমনে ইস্কুলত যাবি দাদা।ওর বাপ এনা গাইট কিনে দিবের পাচ্ছে না। গাইট নাই,পেরাইভেট নাই তাই পড়া পায় না। মাস্টাররা মারে ।তাই ইস্কুলোত যাবার চায় না।“ কথা গুলো আমার মগজে বেশ নাড়া দেয়। কারন কথা সত্যিই ।তার অভাবের সংসারে দুই ছেলে-মেয়েকে সারাদিন ভ্যান চালিয়ে পড়াশুনার খরচ চালানো বেশ কষ্টের। চিন্তার শুরু সেখান থেকেই বলতে গেলে ।

সম্পূর্ন গ্রামীণ একটি পরিবেশে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাটা ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য। কেননা এখানকার পরিবেশ ছিলো আমাদের প্রতিকূলে। একঝাক কিশোরের হাত ধরে যে, এই প্রতিষ্ঠান এতোটা অগ্রসর হতে পারবে তা ছিলো চিন্তার বাইরে। মাত্র দুই টাকা থেকে আমাদের যাত্রা। তখন অনেকের কাছে সংগঠনের মূল চিন্তা বা কাজের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য গেলে কেউ বলতো সাপ্তাহিক দুই টাকা দিয়ে কি হবে? এটা সম্ভব না। এভাবে বেশ হোচট খেলাম। কিন্তু আশার হাল ছাড়লাম না। আমার সমবয়সী যারা আছে তাদের বুঝাতে লাগলাম এই বলে যে, তোমরা তো সিগারেট খাও। ধরো দিনে ৫টা সিগারেট খাও। আর সপ্তাহে ৩০টা। প্রতিটি সিগারেটের দাম ২টাকা হলে সপ্তাহে ৬০টাকা। আচ্ছা এই ৬০ টাকা থেকে যদি ২টাকা দিয়ে গ্রামের যেসব শিক্ষার্থী অর্থের অভাবে পড়াশুনা করতে পারছে না, তাদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে কি খুব খারাপ হবে! প্রথমে কোন উত্তর বা মতামত না এলেও দেখি সবাই একটু বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন ঐ একটাই সপ্তাহে দুই টাকা জমিয়ে আর কতো হবে? এটা দিয়ে অদৌ কি সবার পড়াশুনার খরচ চালানো সম্ভব? কিন্তু কি ভেবে যেনো আমার বড় ভাই ও সহপাঠী মোঃ মহসীন আলী আমার হাতে দুই টাকা দিয়ে বললো দেখি কি করেন। ব্যাস সেই শুরু। আস্তে আস্তে বিষয়টা সবাইকে আরো বুঝাতে লাগলাম। দেখি ধীরে ধীরে মামুন ভাই, রিপন, স্বপন, রাসেল এরা পরের সপ্তাহে আমাকে দুই টাকা করে দিতে শুরু করলো। আমিও আমার ডাইরির শেষ পাতায় সবার নামে ঐ টাকা জমা করলাম। ইতিমধ্যে আমার শিক্ষক প্রভাষক আব্দুল রাজ্জাক স্যারের সাথে এ বিষয়ে একটু আলোচনা হলো। তিনি আমাকে সাহস দিলেন আর বললেন ঠিক আছে আমিও তোমাদের সাথে থাকবো। ধীরে ধীরে টাকার পরিমান ৪০ টাকা হলো। এখন প্রশ্ন আসলো সংগঠনটির নাম, এর ধরন, সদস্য কিভাবে গ্রহণ করা হবে ইত্যাদি বিষয়ে। আমি আর রিপন একদিন বৃষ্টির দিনে আমার দাদা যে বারান্দায় বসে ডাক্তারি করতো সেই জায়গাতে বসে সংগঠনের নাম আর শ্লোগান নিয়ে বেশ চিন্তা করতে শুরু  করলাম। অনেকগুলো নাম আমরা খাতায় লিখলাম। কিন্তু কোন নামই পছন্দ হচ্ছিলো না। এক পর্যায়ে এভাবে “আলোর প্রদীপ” আর “সুন্দর জীবনের প্রত্যয়ে” এই শ্লোগানটি মাথায় চলে আসলো। কিন্তু প্রশ্ন ?  আলোর আর প্রদীপ তো একই অর্থ। তখন চিন্তা করে বের করলাম যে এক অর্থ হলেও আমরা তো প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করতে পারি। আর গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার খরচ আমরা চালাবো।

অতএব,যারা টাকা দিচ্ছিলো তাদের একত্রিত হওয়া জরুরী বিধায় আব্দুল রাজ্জাক স্যারের পরামর্শে সোনাতলা ইউনিয়ন পরিষদের কাজী অফিসে ১১ই অক্টোবর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ একটি সভা আহ্ববান করা হলো। সেই সভায় যথারীতি দেখি সবাই উপস্থিত। স্যারও এলেন সভায়। আমরা তো কিছুই বুঝি না তাই সভার সব দায়িত্ব স্যারের উপর দেওয়া হলো। দীর্ঘ আলোচনার পর আমাদের প্রস্তাবকৃত নাম, শ্লোগান, সংগঠনের ধরন, সদস্যপদ প্রদানের প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলো। আমার দিব্যি মনে আছে সেদিনের সভা শেষে উকিল ভাইয়ের দোকান থেকে দুই প্যাকেট চানাচুর আর সল্টেচ বিস্কুট দিয়ে আমাদের অ-আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। পরে সদস্যপদ প্রদানের জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম চালু করা হলো। আস্তে আস্তে সদস্য ফরম, সদস্যপদ বাড়ানো সহ সার্বিক কার্যক্রম এগিয়ে যেতে থাকলো।

সিদ্ধান্ত হলো আমরা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার সকল  খরচ সংগঠন থেকে বহন করবো। মেধাবী নয় বরং শিক্ষার্থী নির্বাচনে তার পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য ও দারিদ্রতা বিবেচ্য হবে। ব্যাস শুরু সেখানেই । আশার কথা একটাই যে আজ পর্যন্ত আমরা ৭৮ জন অতি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম হয়েছি। ধীরে ধীরে সদস্যপদ সংখ্যা বাড়তে থাকলো যে ধারা আজও অব্যাহত আছে। আমি সংগঠনের যাত্রা লগ্নের সদস্যদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ যে তারা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে কি আপ্রাণ প্রচেষ্টা বা শ্রম দিয়েছিলো তা বলার মতো না। সেসব সদস্যর মধ্যে বিশেষ করে মহসীন আলী, মেহেদী হাসান, রাসেল, রাজ্জাক স্যার, মোখছেদুল ইসলাম, আজাদ হোসেন, শাহাব উদ্দিন, মনিরুল, মেহেদী হাসান বাপ্পী, রবিউল আউয়াল, হাসিবুল হাসান অনিক, সানাউল হক, পাভেল কাজী, আব্দুল মমিন, মতিয়ার হোসেন, সুলতান আকন্দ, প্রমূখ নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে পরবর্তীতে আরো যারা এসেছেন তারাও যে সংগঠনের জন্য কম পরিশ্রম করেছেন বা এখনো করে যাচ্ছেন তা অস্বীকার করা যায় না। সংগঠনের এতো দূর আসার পেছনে আমাদের প্রত্যকটি সদস্যর অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। আমাদের উপদেষ্টা তারাও আমাদের প্রতিনিয়তই তাদের বুদ্ধি ও চেতনাদীপ্ত পরামর্শ প্রদান ও কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আরো কৃতজ্ঞতা না জানালে বড়ই অকৃতজ্ঞের পরিচয় দেয়া হবে, সোনাতলা ইউনিয়ন কাজী অফিস, আমলীতলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সোনাতলা প্রি-ক্যাডেট স্কুল ও সোনাতলা সদর ইউনিয়ন পরিষদসহ কাবিলপুর গ্রামের নেতৃস্থানীয় সুধীবর্গ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ, অগ্রজবৃন্দ, রাজনীতিবিদ,সোনাতলা প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকবৃন্দ ও অত্র উপজেলার সকল জনসাধারনের প্রতি। তারা আমাদের প্রত্যেকটি কাজে স্নেহ-বাৎশল্য  মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের আলোর প্রদীপ কে মহীরূপে রূপান্তরিত  করার পথে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন তা চিরস্বরনীয় হয়ে থাকবে।

 

 

 

এম এম মেহেরুল

প্রতিষ্ঠাতা

আলোর প্রদীপ ।

প্রধান উপদেষ্টা

মোঃ আব্দুল রাজ্জাক

সহযোগী অধ্যাপক
সরকারি কুমুদিনী মহিলা কলেজ, টাঙ্গাইল

চেয়ারম্যান

এম এম মেহেরুল

 

সাধারণ সম্পাদক

মোঃ বোরহান উদ্দিন